Spread the love

রাধাগোবিন্দ কর: মানবতার সেবায় আত্মনিবেদিত এক মহাপুরুষ এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত R G Kar মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের অনন্য ইতিহাস

কলকাতার শহরের মিশ্র ঐতিহ্য ও আধুনিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হল R G Kar মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।এই হাসপাতালের নাম শুনলেই এক ধরনের গর্ব অনুভব করা যায়, কিন্তু এর পেছনের ইতিহাস, যেটি আমাদের অনেকেরই অজানা, তা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আসুন, আজ আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো এই হাসপাতালটির গঠন ও প্রতিষ্ঠাতার জীবনকথা।

রাধাগোবিন্দ কর: চিকিৎসাবিজ্ঞানের রেনেসাঁ পুরুষ

১৮৫২ সালের ২৩শে আগস্ট হাওড়া জেলার রামরাজাতলা স্টেশনে জন্মগ্রহণ করেন রাধাগোবিন্দ কর। তাঁর বাবা দুর্গাদাস কর ছিলেন একটি প্রভাবশালী ব্যক্তি, যিনি ঢাকায় মিডফোর্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই রাধাগোবিন্দ কর ছিলেন মেধাবী এবং শিক্ষা জীবনে উচ্চ ফলনশীল। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা হেয়ার স্কুলে সম্পন্ন হয়, এবং এরপর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাঠ নিতে ভর্তি হন।

রাধাগোবিন্দ করের চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রতি আগ্রহ ছিল প্রবল। ১৮৮০ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তিনি দ্রুতই নিজের প্রতিভা প্রমাণ করেন। পরবর্তীতে, ১৮৮৩ সালে, তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান এবং সেখানে MRCP (মেম্বার রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিশিয়ানস) ডিগ্রি অর্জন করেন। বিদেশে থেকে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও, তিনি মাতৃভূমি বাংলার জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।

বাংলায় চিকিৎসার সংকট এবং সমাধান

যখন রাধাগোবিন্দ কর কলকাতায় ফিরে আসেন, তখন বাংলার চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেকটাই সংকটাপন্ন ছিল। বিশেষ করে, সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করা ছিল বেশ কঠিন। চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষার অভাব ছিল, এবং বাংলায় চিকিৎসা বিষয়ক বইয়ের অভাব ছিল প্রকট। রাধাগোবিন্দ কর এই অভাব পূরণ করতে তৎপর হন এবং বাংলা ভাষায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বই লিখেন।

তিনি বাংলা ভাষায় লেখা বইগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘ভিষগবন্ধু’, ‘সংক্ষিপ্ত শারীরতত্ত্ব’, ‘রোগী পরিচর্য্যা’, ‘ভিষক সুহৃদ’, ‘প্লেগ’, ‘স্ত্রীরোগের চিত্রাবলী ও সংক্ষিপ্ত তত্ত্ব’, ‘সংক্ষিপ্ত শিশু ও বাল চিকিৎসা’, ‘সংক্ষিপ্ত ভৈষজতত্ত্ব’, ‘কর সংহিতা’, এবং ‘কবিরাজ ডাক্তার সংবাদ’। এই বইগুলি চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

https://www.facebook.com/profile.php?id=61563378620082

হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ

রাধাগোবিন্দ কর জানতেন যে, শুধুমাত্র বই লেখার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে না। এজন্য, তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে বাংলার সাধারণ মানুষের জন্য একটি হাসপাতাল তৈরি করবেন। কিন্তু, সেই সময়ে হাসপাতাল স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কোথায় পাবেন?

রাধাগোবিন্দ কর একটি অনন্য পথ অবলম্বন করেন। তিনি কলকাতার ধনী পরিবারের কাছে ভিক্ষা করতে শুরু করেন। একদমই অস্বস্তিকর ও দুর্ভাগ্যজনক হলেও, একমাত্র হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কল্পনা করুন, একজন বিদেশে পড়াশোনা করা MRCP ডাক্তার নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য ভিক্ষা করছেন। এভাবে, তিনি বিভিন্ন উৎসব, অনুষ্ঠান, ও সামাজিক gatherings-এ গিয়ে টাকা সংগ্রহ করেন।

হাসপাতালের প্রতিষ্ঠা

১৮৯৯ সালে, রাধাগোবিন্দ কর বেলগাছিয়ায় একটি জমি কিনেন এবং সেখানে হাসপাতাল নির্মাণের কাজ শুরু করেন। ২৫ হাজার টাকায় কেনা ১২ বিঘে জমিতে ৭০ হাজার টাকার ব্যয়ে একটি হাসপাতাল গড়ে তোলেন। হাসপাতালের শুরুর দিকে শয্যার সংখ্যা ছিল ৩০। হাসপাতালটি প্রাথমিকভাবে ‘অ্যালবার্ট ভিক্টর হাসপাতাল’ নামে পরিচিত ছিল।

এই সময়ের মধ্যে, প্রিন্স অ্যালবার্ট ভিক্টর হাসপাতাল পরিদর্শন করে ১৮ হাজার টাকা দান করেন, যার কারণে হাসপাতালের নাম রাখা হয়েছিল ‘অ্যালবার্ট ভিক্টর হাসপাতাল’। ১৯০৪ সালে, রাধাগোবিন্দ করের উদ্যোগের সঙ্গে মিশে যায় কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস অব বেঙ্গল। পরবর্তীতে, ১৯১৬ সালের ৫ জুলাই, লর্ড কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতল ভবনের উদ্বোধন করেন এবং হাসপাতালের নাম বদলে ‘কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ’ রাখা হয়।

 R G Kar মেডিক্যাল কলেজ

স্বাধীনতার পরের নাম পরিবর্তন

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় রাধাগোবিন্দ করের নাম পুনরায় প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ নেন। তাঁর চেষ্টা সার্থক হয় এবং মেডিক্যাল কলেজের নাম পরিবর্তন করে ‘আর.জি.কর মেডিক্যাল কলেজ’ রাখা হয়।

এই নাম পরিবর্তন রাধাগোবিন্দ করের অবদানকে সম্মান জানিয়ে, তাঁর কাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। আজও, এই মেডিক্যাল কলেজ বাংলার সেরা সরকারী হাসপাতালগুলির মধ্যে একটি হিসেবে পরিচিত।

মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

১৯১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর, রাধাগোবিন্দ কর ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুর সময় তাঁর নিজের কিছুই ছিল না। সমস্ত সম্পত্তি ও উপার্জন তিনি মেডিক্যাল কলেজে দান করে যান। তাঁর মৃত্যু একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে, যেখানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হাজার হাজার মানুষের চিকিৎসা সেবা করে যাচ্ছে।

রাধাগোবিন্দ করের জীবনকথা আমাদের শিখায় যে, সত্যিকারের মানবিকতার অর্থ কী হতে পারে। তাঁর আত্মনিবেদন, উদারতা, ও পরিশ্রম আজও আমাদের প্রেরণা দেয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান আজও তার লক্ষ্য পূরণের পথে অবিচল রয়েছে, যা আমাদের জন্য একটি সৎ এবং অসাধারণ শিক্ষা। READ MORE……


Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *